অণু এবং সংকেত (Formula)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ | NCTB BOOK

আমরা শিখেছি যে দুই বা ততোধিক পরমাণুর সমন্বয়ে অণু তৈরি হয়। সংকেত থেকে কোন অণুতে কোন পরমাণু কতগুলো করে আছে, তা জানা যায়। একটি সংকেত আসলে একটি অণুর সংক্ষিপ্ত রূপ। অণু গঠনকারী পরমাণুর চিহ্ন দিয়ে একটি সংকেত লেখা হয়। এখন আমরা সংকেত লেখার নিয়ম এবং সংকেত থেকে কি বোঝা যায় তা জানব।

মৌলের উদাহরণ

যেসকল মৌল সাধারণত, তরল ও কঠিন অবস্থায় থাকে, সেখানে অসংখ্য পরমাণু একসঙ্গে অবস্থান করে কিন্তু সেগুলো কোনো অণু গঠন করেনা। যার ফলে, সোডিয়াম, তামা এবং লোহার মতো এই জাতীয় মৌলের জন্য অণু হিসেবে কোনো সংকেত নেই। তবে কয়েকটি নিস্ক্রিয় গ্যাস ছাড়া বেশির ভাগ গ্যাসীয় পদার্থ দুটি মৌল একত্র হয়ে একটি অণু গঠন করে। যার ফলে, এসব মৌলের সংকেত হিসেবে সেগুলোর প্রতীকের সঙ্গে ছোট করে ‘২’ (2 as subscript) লিখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অক্সিজেনের সংকেত হলো ০, এবং নাইট্রোজেনের সংকেত হলো N,। তবে কিছু কিছু মৌল আছে যেগুলো কঠিন এবং তরল অবস্থাতেও নিজেদের দুটি পরমাণু একত্র হয়ে অণু গঠন করে। সেগুলোর সংকেতও ঠিক আগের মতো করে লিখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রোমিন (তরল) এর সংকেত Br ।

মৌলপ্রতীক সংকেত
হাইড্রোজেনHH2
নাইট্রোজেনNN2
অক্সিজেনOO2
ফ্লোরিনFF2
ক্লোরিনClCl2
ব্রোমিনBrBr2
আয়োডিনII2

অণু এবং যৌগিক পদার্থের উদাহরণ

পানি: যৌগের সংকেত থেকে আমরা জানি কোন কোন মৌলের পরমাণুর সমন্বয়ে যৌগটি গঠিত এবং ঐ যৌগে সেসব উপাদান মৌলের পরমাণুর অনুপাত কত। উদাহরণস্বরূপ, H,O সংকেত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি অক্সিজেন পরমাণুর সমন্বয়ে একটি পানির অণু গঠিত হয়েছে।

কার্বন ডাইঅক্সাইড: আমাদের পরিচিত আরেকটি গ্যাস হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড। আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ করি, কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিত্যাগ করি। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে গ্রিন হাউস ইফেক্ট-এর মাধ্যমে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে পৃথিবীর আবহাওয়ার ভয়াবহ পরিবর্তন হচ্ছে। কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণু তৈরি হয় কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে। এই অণুতে একটি কার্বনের পরমাণুর সঙ্গে দুইটি অক্সিজেনের পরমাণু থাকে। কার্বনের প্রতীক C, অক্সিজেনের O, তাই কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণুর সংকেত CO। কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে আরো একটি অণু তৈরি হয় সেই অণুটির নাম কার্বন-মনোক্সাইড। কার্বন মনোক্সাইডে একটি কার্বন পরমাণুর সঙ্গে একটি অক্সিজেনের পরমাণু যুক্ত হয় এবং তার সংকেত হচ্ছে CO। কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসটি মোটামুটি নিরীহ একটি গ্যাস; কিন্তু কার্বন মনোক্সাইড অত্যন্ত ভয়ংকর বিষাক্ত একটি গ্যাস। কাজেই দেখতে পাচ্ছ, একই পরমাণু ব্যবহার করে খুবই সাধারণ অণু যেরকম তৈরি করা যায়, ঠিক সেরকম সম্পূর্ণ ভিন্ন খুবই বিষাক্ত গ্যাসের অণু তৈরি করা যায়।

কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণু তৈরি হয়েছে একটি কার্বন এবং দুইটি অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে।

লবণ: আমরা তরল হিসেবে পানি এবং বিভিন্ন গ্যাসের অণুর কথা বলেছি, এবারে আমরা কঠিন পদার্থের অণুর উদাহরণ দিই । আমরা সবাই প্রতিদিনই আমাদের খাবারের সঙ্গে লবণ ব্যবহার করি। লবণ তৈরি হয় সোডিয়াম (Na) এবং ক্লোরিন (Cl) এর পরমাণু দিয়ে। যেহেতু লবণের যৌগিক পদার্থে একটি সোডিয়াম এবং একটি ক্লোরিনের পরমাণু থাকে, তাই লবণের সংকেত হচ্ছে NaCl। তরল কিংবা গ্যাসে অণুগুলোর নির্দিষ্ট অবস্থান থাকে না, সেগুলো ক্রমাগত নড়াচড়া করতে থাকে। কিন্তু কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট স্থানে আটকে থাকে। সে দিক দিয়ে লবণের একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য আছে। লবণের অণুগুলো এলোমেলোভাবে না থেকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে কেলাস বা ক্রিস্টাল হিসেবে সাজানো থাকে।

লবনে সোডিয়াম এবং ক্লোরিনের সুসজ্জিত কেলাস।

সোডিয়ামের পরমাণুটি অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল একটি ধাতু। খোলা বাতাসে রাখলে এটিতে আগুন ধরে যেতে পারে, আবার পানির সঙ্গে এটি ভয়ংকরভাবে বিক্রিয়া করে বলে সোডিয়ামকে সব সময় কেরোসিনে ডুবিয়ে রাখতে হয়। একইভাবে ক্লোরিনও খুবই বিক্রিয়াশীল এবং বিষাক্ত একটি গ্যাস, কিন্তু তোমরা সবাই জানো, এই সোডিয়াম এবং ক্লোরিনের পরমাণু মিলে যে লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড নামে যে যৌগিক পদার্থ তৈরি হয়, সেটি মোটেও বিক্রিয়াশীল বিপজ্জনক কোনো পদার্থ নয়। আমরা প্রতিদিন লবণ খাই এবং আমাদের শরীরের জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয় একটি পদার্থ। শুধু তাই নয়, লবণের কেলাসের ভেতর সোডিয়াম এবং ক্লোরিন এত শক্তভাবে আবদ্ধ থাকে যে হঠাৎ করে সোডিয়াম এবং ক্লোরিন মুক্ত হয়ে কোনো বিপদ তৈরি করতে পারে না৷

সোডা: আমরা এখন পর্যন্ত শুধু দুটি পরমাণু দিয়ে তৈরি অণুর উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু দুই থেকে বেশি পরমাণু দিয়েও অণু তৈরি হওয়া সম্ভব। যেমন কাপড় ধোয়ার সোডা সোডিয়াম, কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে তৈরি। কাপড় ধোয়ার সোডার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে সোডিয়াম কার্বনেট এবং তার সংকেত হচ্ছে Na,CO,। কাজেই সংকেতটি দেখেই তোমরা অনুমান করতে পারছ, যে সোডিয়াম কার্বনেটে অণুর মধ্যে দুইটি সোডিয়ামের পরমাণু, একটি কার্বনের পরমাণু এবং তিনটি অক্সিজেনের পরমাণু থাকে ।

চিনি: আমরা সবাই মিষ্টি চিনির সঙ্গে পরিচিত। মিষ্টি খেতে ভালো লাগে বলে অনেক সময় বেশি চিনি খাওয়ার কারণে আমরা নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়ি। চিনির অণুটি তৈরি হয়েছে কাৰ্বন (C), হাইড্রোজেন (H) এবং অক্সিজেনের (O) পরমাণু দিয়ে। চিনির সংকেত হচ্ছে C,H,O, এবং এটা দেখেই বুঝতে পারছ চিনির অণুতে ১২টি কার্বন, ২২টি হাইড্রোজেন এবং ১১টি অক্সিজেনের পরমাণু রয়েছে। এখন পর্যন্ত তোমাদের যে কয়টি অণুর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরমাণু দিয়ে তৈরি!

কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন দিয়ে তৈরি চিনির অণু।

হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড: তোমরা সবাই নিশ্চয়ই কমবেশি অ্যাসিড শব্দটি শুনেছ। লেবুর রস কিংবা ভিনেগারে দুর্বল অ্যাসিড থাকে এবং আমরা সেগুলো খাবারের মধ্যে ব্যবহার করি। এর পাশাপাশি কিছু অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যাসিড আছে, যেগুলো লোহাকে গলিয়ে ফেলতে পারে, চামড়ার সংস্পর্শে আসলে সঙ্গে সঙ্গে চামড়াকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। সেরকম কয়েকটি অ্যাসিড হচ্ছে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড এবং নাইট্রিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডগুলো খুবই সাবধানে ব্যবহার করতে হয় এবং কেউ ইচ্ছা করলেই সেটি বাজার থেকে কিনে আনতে পারে না।

কিন্তু একটি বিস্ময়কর ব্যাপার কি জানো? এই তিনটি অত্যন্ত বিপদজনক অ্যাসিডের ভেতর একটি অ্যাসিড কিন্তু তোমার নিজের অজান্তেই বহন করো এবং সারাক্ষণ ব্যবহার করে যাচ্ছ; সেটি হচ্ছে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, একটি হাইড্রোজেন (H) পরমাণু এবং একটি ক্লোরিন (Cl) পরমাণু দিয়ে তৈরি, এই অ্যাসিডের সংকেত হচ্ছে HCl। তোমার পাকস্থলীতে খাদ্য পরিপাক করার জন্য সেখানে এই অ্যাসিড থাকে। যদিও এটি চামড়ার সংস্পর্শে এলে চামড়া পুড়ে যায়; কিন্তু পাকস্থলীর আবরণের কোনো ক্ষতি না করেই সেটি পাকস্থলীতে সংরক্ষণ করতে পারে।

মৌলিক পদার্থ, যৌগিক পদার্থ, অণু এবং পরমাণু সম্পর্কে বলার সময় শুধু পরিচিত পদার্থের উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পদার্থগুলো তোমাদের আশপাশে আছে এবং তোমরা এগুলো প্রতিদিন কিংবা নিয়মিত ব্যবহার করে থাকো। তোমরা যখন উপরের ক্লাসে যাবে, তখন মৌলিক পদার্থ, যৌগিক, পরমাণু, অণু এবং সেগুলোর ভেতরকার বিভিন্ন রাসায়নিক বন্ধন সম্পর্কে আরো নতুন নতুন বিষয় জানতে পারবে। যেমন তোমরা জানতে পারবে পানির অণুতে একটি অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে সবসময় দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। কেন দুইটির বেশি কিংবা কম থাকে না? একইভাবে তোমরা জানতে পারবে কেন লবণের অণুতে একটি সোডিয়ামের পরমাণুর সঙ্গে সব সময় একটি ক্লোরিনের পরমাণু যুক্ত হয়, বেশি বা কম কেন যুক্ত হয় না?

তোমরা যতই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবে, ততই প্রকৃতির এরকম নানা ধরনের বিস্ময়কর রহস্য তোমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকবে।

Content added || updated By
Promotion